বাজেট প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। যারা সরকারি দলে, তারা আনন্দ মিছিল করে বলতেন- কোনোকালে এত ভালো বাজেট হয়নি। আরেক দল জ্বালাও-পোড়াও স্লোগান দিয়ে বলত, এমন পচা বাজেট কখনো দেখিনি।
উভয়দলের এই উগ্রতা প্রমাণ করে, আমাদের জাতির কোনো ভারসাম্য নেই। অথচ বাজেট ভালো হলে দুই দলের মানুষ এর সুফল ভোগ করে আর খারাপ হলেও উভয় দলের লোকরাই কষ্ট পায়। বাংলাদেশে বাজেট পেশ করা হয়েছে সংসদে।
এবার একটি বিষয় যেমন সবাই মিস করেছেন, তেমনি উপভোগ করেছেন নতুন কিছু। মিসিং ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রীর কথা। পড়ন্ত বয়সেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলতে পারা সেই মানুষ কথায় কথায় ‘বোগাস’, ‘রাবিশ’ বলে হাসি-আনন্দে মানুষকে ভরিয়ে রাখতেন। মাঝে মধ্যে এমন সব বেফাঁস কথা বলতেন, শুনলে মনে হতো, তিনি কি আসলেই মন্ত্রী? বয়সের ভারে কাবু না হলেও বয়সের চাপ এড়াতে পারেননি আবুল মাল আবদুল মুহিত।
এবার যেটি অভিনব ছিল, তা হলো প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা। অর্থমন্ত্রীর শারীরিক অসুস্থতা যখন তাকে বাজেট পড়তে বাধা দিচ্ছিল, তখন ওই কাজটি স্বচ্ছন্দে করে দিলেন শেখ হাসিনা। তিনি পারেনও বটে! তারও বয়স হয়েছে। অথচ এখনো সম্পূর্ণ সচল আর গতিময়ী। এ এক ধরনের ভালোবাসা আর প্রেরণা বৈকি। এখন কথা হলো, বাজেট আসলে কী দেবে আর কী দেবে না? এ কথার উত্তর দেওয়া সহজ কিছু নয়। কিন্তু এটি নিশ্চিত, আমাদের দেশে যারা গরিব বা মধ্যবিত্ত, তাদের কপালে সহজে পরিবর্তন আসে না।
এবারও তা-ই মনে হচ্ছে। উল্টো দ্রব্যমূল্য আর মোবাইল ফোন নিয়ে তাদের দুর্ভাবনা বাড়বে। কর দেওয়ার ব্যাপারটি সহজ নয়। আর এখানে ফাঁকি দেওয়ারও চান্স নেই। মোবাইল ফোনে ১০০ টাকা ঢুকলে সরকার তার ভাগ কেটে নেবে। উচ্চাভিলাষী বাজেট আর মধ্যআয়ের দেশ হওয়ার কথা বাজারে বড় চালু। সেভাবেই বাজেট হয়েছে। এবার আপনারাই জানেন, কতটা নিতে পারবেন আর কতটা পারবেন না। তবে এটি নিশ্চিত, সহ্য করতেই হবে। কারণ কেউ নেই, কোনো রাজনীতি নেই, আসলে বর্তমান সরকার বা শাসনের কোনো বিকল্পও নেই। অর্থনীতি আমার বিষয় ছিল। কিন্তু অর্থনীতি বোঝা কখনো হয়ে ওঠেনি।
মূলত যারা বড় বড় অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত, তাদের কেউ মন্ত্রী হতে চাননি বা মন্ত্রী-মিনিস্টার হয়ে বাজেটও পেশ করেননি। তাদের কাজ বাজেট ঘোষণার পর সেসব নিয়ে গবেষণা আর কথা বলা। আমার মতো সাধারণ মানুষের কলমে মূলত সেসব বিষয়ই আসেÑ যা আমাদের দেশে বা দেশের বাইরে ভাবিত করে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কোনটি সত্য, কোনটি আসলে মেকি। রাজনীতি প্রায় মৃত। সমাজে এর কোনো প্রভাব নেই।
আজকের মিডিয়াজুড়ে কোথাও প্রতিবাদের ছবি দেখিনি। প্রতিবাদ করতেই হবে, কথা নেই এবং অন্যায্য প্রতিবাদের দরকারও নেই। কিন্তু একটা সময় ছিল-যখন ভালো হোক আর মন্দ হোক, এক দল বলত বাজেটকে শুভেচ্ছা-স্বাগতম, আরেক দল রাস্তায় নেমে বাজেটবিরোধী গরম গরম স্লোগান দিয়ে মানুষকে জানাত কোথায় কোথায় কী কী ভুল হয়েছে। এই প্রয়োজন এখন মিডিয়া পূরণ করে।
সামাজিক মিডিয়া তো আরও এককাঠি সরেস। এখানে ঘোষণার আগে যেমন বিশেষজ্ঞরা ওতপেতে বসে থাকেন, তেমনি ঘোষণার পর নেমে পড়েন ব্যবচ্ছেদে। তাই মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার আগে আসল তথ্য আর বাজেটে যাওয়া জরুরি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১৩ জুন সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, এতে মোবাইল সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছেন। ফলে মোবাইল ফোনে কথা বলা, এসএমএস পাঠানো ও ডেটা ব্যবহারের খরচও বেড়ে যাবে।
মোবাইল ফোন অপারেটররা বলছে, এর ফলে মোট বর্তমানে সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ১ শতাংশ সারচার্জ, ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং অন্যান্য মিলে মোট কর দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ালে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কেউ যদি ১০০ টাকার সেবা নিতে চান, তা হলে ৭৮ দশমিক ২৭ টাকার সেবা নিতে পারবেন। ২২ দশমিক ৭২ টাকা যাবে সরকারের পকেটে।
এই যে খবরটি, এটি অনেক জরুরি। কারণ মানুষ এখন ভাত-ডালের পর মোবাইল ফোননির্ভর। এই মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট না হলে তার জীবন অচল। শুধু বিনোদন বা আনন্দের জন্য নয়, প্রয়োজনেও এর ব্যবহার এখন অনিবার্য। আপনি একটি ট্যাক্সি ডাকবেন, উবার কল করবেন, পাঠাও আনবেন-মোবাইল লাগবে। খাবার থেকে ঘুমানো- সব কিছুতে এই জরুরি বিষয়ে মূলত ভালো কর আরোপ করার মাধ্যমে দুটি বিষয় পরিষ্কার। প্রথমত, সরকার জানে, কোথা থেকে রাজস্ব আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মানুষের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের একটি পলিসি হতে পারে এই কর। তেমনি সিগারেট নিয়েও দেখলাম ট্রল হচ্ছে। আপাতত সিগারেট তেমন জরুরি বিষয় নয়। শেষ করব কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের উক্তি দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘বাজেট উপরে স্যাটেলাইট/নিচে হালুয়া টাইট’। দেখার বিষয়, আসলে কি তা-ই? না, এই বাজেট কিছুটা হলেও কষ্ট লাঘব করবে মানুষের। এটি মানতে হবে, মধ্যবিত্তের চেহারা বদলায়নি, বরং তাদের কষ্ট বেড়েছে। কৃষকের খবর সবার জানা। কত কত ফ্যাক্টরি বেতন দিতে পারে না। সাংবাদিকরা মাস শেষে বেতন পান না। তেমনি দেশে বাজেট কি আসলেই অভাব মোচন করতে পারে?
সবার ওপর জবাবদিহি আর অর্থনীতিকে সাধারণের বোধগম্য আর সহজ করে তোলা। সেটি হয়নি। একদিকে বড়লোক বা ধনীদের প্রভাব বাড়ছে। বাইরে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সেসব দিক যদি সামাল দেওয়া না হয় তো কালো টাকা সাদা করতে করতেই জীবন পার হবে। কঠিন একটি বিষয় হলো অর্থনেতিক ভারসাম্যহীনতা। এটি বাংলাদেশে প্রবল। তাই ব্যবধান কমানোর বাজেট ছিল প্রত্যাশিত। বলছি না তা নেই। কিন্তু জনকল্যাণমুখী বলতে যা বোঝায়, তা কি আসলে আছে? না এই বাজেট গরিবের মুখে হাসি ফোটাবে? সরকারের ভালোমন্দ-সব কাজই মূলত মূল্যায়িত হবে আর্থিক সফলতায়। দেখা যাক, উচ্চাভিলাষী এই বাজেট কত দূর নিতে পারে, নিয়ে যায় বাংলাদেশকে।
অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক